পর্ব:- ০২
Writer:- Hassab bin Ahmed
কোন লোকজন নেই, বিয়ে হয়ে গেল — এখন রেহনুমাকে নিয়ে ফেরার সময়…………
আমাদের বিদায় দেওয়া হলো। আমরা বাসা থেকে বের হলাম। রেহনুমা কেঁদে যাচ্ছে। রেহনুমার সঙ্গে কিছু নেই বলে আমি বললাম—
আমি: শুনেন, আপনি মনে হয় আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিতে ভুলে গেছেন?
রেহনুমা: জি, কিন্তু নেওয়ার মতো যে আমার কিছুই নেই। শুধু কিছু কাপড় নিয়েছি।
এই বলে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ আমাকে দেখালো। আমি ব্যাগটি হাতে নিয়ে বললাম—
আমি: আচ্ছা ঠিক আছে, চলেন। আপনি কি হেঁটে যেতে পারবেন?
রেহনুমা: জি, পারবো ইনশাআল্লাহ। (কান্না জড়িত কণ্ঠে)
আমি আর রেহনুমা আগে আগে যাচ্ছি; পিছনে নাছির আর নাছিরের আব্বা আসছেন।
আমি: আপনি কান্না বন্ধ করুন। আপনি যদি এভাবেই কাঁদেন তাহলে আপনার শরীর খারাপ হবে।
রেহনুমা কিছুই বললো না।
আমি: দেখুন, এই রাত করে কোথায় যাবো? আজ রাত আমার বন্ধু নাছিরদের বাসায় থাকবো; কাল ইনশাআল্লাহ আমাদের নতুন বাসায় যাবো।
রেহনুমা: জি, ঠিক আছে।
নাছিরদের বাসায় এসে পৌঁছালাম। ভাবি (নাছিরের বউ) রেহনুমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমি আর নাছির একটু গল্প করছিলাম।
নাছির: হুম, অনেক হয়েছে; এখন ভাবি একা একা বসে আছে, সারাদিন তো কম ধকল যায়নি।
আমি: হুম, ঠিক বলেছিস।
ঘরে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম — পুরো ঘর ফুল দিয়ে সাজানো। ফুলের সুবাসে ঘুমঘুম করছে। তার ভিতরে বসে আছে রেহনুমা। আমি গিয়ে সালাম দিলাম। রেহনুমা খাট থেকে নেমে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো; আমি রেহনুমাকে তুলে নিলাম।
আমি: পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয় না; অনেক আলেম এটা হারাম বলেছেন। ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী আপনি সালাম দিয়ে, প্রয়োজনে আলিঙ্গন করতে পারেন; হাতে বা কপালে চুমু দিতে পারেন। এটা সুন্নাহ অনুযায়ী বৈধ।
রেহনুমা: জি, ঠিক আছে।
আমি: চলেন, দু’রাকাত নামাজ আদায় করে নেই।
তারপর দু’রাকাত নামাজ পড়ে খাটে এসে বসলাম। টেবিলের উপর অনেক ধরনের খাবার রাখা আছে।
আমি: আপনি কিছু খেয়ে নিন।
রেহনুমা: আমি খাবো না, আপনি খান।
আমি: ঠিক আছে — অন্তত এই খুশির সময় একটি মিষ্টি খান।
রেহনুমা: না, আমি খাব না, আপনি খান!!
আমি: আপনাকে এই প্রথম একটি অনুরোধ করলাম — অন্তত আমার জন্য খান, প্লিজ।
রেহনুমা প্লেট থেকে একটি মিষ্টি নিলো। আমি আর রেহনুমা একটি করে মিষ্টি খেলাম।
আমি: আচ্ছা, দুধও খেয়ে ফেলো — নাহলে নষ্ট হয়ে যাবে।
রেহনুমা: হুম, আপনি আগে খান।
আমি: না না, আপনি খান।
রেহনুমা: আপনি আগে খান, আমি পরে খাব।
আমি: ঠিক আছে।
রেহনুমা আর আমি দুইজনই খাটের উপর বসে আছি।
আমি: আচ্ছা, আপনি এত বড় ঘরের মেয়ে; আমি সামান্য রিকশা চালক। আপনি জেনে শুনে আমার সঙ্গে বিয়েতে রাজি হলেন কেন?
রেহনুমা: মা তো আমাকে সব সময় বলতেন — কোনো ফকিরের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিবে। আপনি তো তাঁর থেকে অনেক ভালো। (কান্না জড়িত কণ্ঠে)
আমি: আজ আমাদের বিয়েটা হঠাৎ হয়ে গেল; কাল আমরা অন্য কোথাও চলে যাবো। তুমি কি কারও সঙ্গে দেখা করতে চাও?
রেহনুমা: আমি আর কার সঙ্গে দেখা করবো? এখন তো আপনার সঙ্গে এসেছি।
আমি রেহনুমার উভয় হাত ধরে বললাম—
আমি: দেখ, আমরা একে অপরের সাথী। আমাকে সব কথা বলতে পারো।
রেহনুমা: সত্যি বলতে, আমি চেয়েছিলাম আমার দুই বোন আমার বিয়েতে উপস্থিত থাকুক; মরমী আর নিশী আমাকে অনেক ভালোবাসে। (কান্না জড়িত কণ্ঠে)
রেহনুমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম—
আমি: আমরা কাল প্রথমে ওদের হোস্টেলে যাবো, ঠিক আছে? তারপর বাসায় যাবো।
রেহনুমা: হুম, কিন্তু গাড়ি ভাড়া লাগবে বেশি।
আমি: আমার মহারানীর খুশির সামনে গাড়ি ভাড়া কিছুই না। এবার একটু হাসো — তুমি কান্না করলে সত্যিই আমার খারাপ লাগে।
রেহনুমা আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে আছে। মনে হচ্ছে আমাদের জনম-জনমের চেনা; কিন্তু আমরা দেখা করেছি কেবল আজ সকালে। এই ছোট মুহূর্তের মধ্যে একজন মানুষ কতটা আপন হতে পারে!
রেহনুমা: আচ্ছা, আপনার বাসা কোথায়?
আমি: কেন আমার উপর ভরসা নেই?
রেহনুমা: ভরসা করেই তো আপনার সঙ্গে চলে এলাম।
আমি: হুম।
রেহনুমা: একটা কথা বলি — রাগ করবেন না তো?
আমি: কী বলছো, রাগ করবো কেন? বলো।
রেহনুমা: না মানে, আপনি এত মোহরানা ধার্য করেছেন কেন? আপনি হয়তো জানেন এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক আছে, যা হয়েছে হয়েছে — আমি আপনার মোহরানা নিয়ে…
আমি: চুপ — আর একটাও কথা যেন মুখ দিয়ে না বের হয়। আমি কি তোমাকে মাফ করে দিতে বলেছি? আমি নিজের ইচ্ছায় মোহর ঠিক করেছি।
রেহনুমা: কিন্তু এতগুলো টাকা…?
আমি: দেখো, কিছুদিন আগে আমি একটি হাদিস পড়েছিলাম — নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজের স্ত্রীর কাছে উত্তম। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৯৭৭)
আমি তোমার কাছে ভালো হতে চাই। যদি আমি কখনো কোনো ভুল করি, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর আমাকে বলো, আমি তোমার কাছে কিভাবে ভালো হতে পারি। আমি তোমাকে সম্মান করে যা দিয়েছি তা গ্রহণ করো।
রেহনুমা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
রেহনুমা: নাছির ভাই আপনার কেমন বন্ধু?
আমি: কেন? ভালো বন্ধু।
রেহনুমা: না মানে, নাছির ভাই ইঞ্জিনিয়ার।
আমি: হুম, ও খুব ভালো — গরিব-ধনী নিয়ে ও চলে না।
রেহনুমা: হুম।
রেহনুমা: আচ্ছা, রাত তো অনেক হলো; ঘুমাবেন না?
আমি: না, আজ ঘুমাবোনা; কিন্তু একটু শুইয়ে নিই।
রেহনুমা: এই ঘরে তো ঘড়ি নেই।
আমি: ঐ কালো ব্যাগটি দেখতে পারছো?
রেহনুমা: হুম।
আমি: ঐ ব্যাগে আমার মোবাইল আছে; নিয়ে আনে তো?
রেহনুমা মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আইফোন ১১ ব্যবহার করি। আমি মোবাইল এগিয়ে দিলে—
রেহনুমা: আপনার এতো দামি ফোন! এই ফোন তো মরমির কাছে আছে — এটি কি অনেক দামি?
আমি: হুম, এখানে অবাক হওয়ার কী আছে? গরিব বলে আইফোন চালাতে পারবো না?
রেহনুমা: না মানে…
আমি: কাজ হয়েছে!
রেহনুমা: কী হয়েছে?
আমি: দেখো — আম্মার সাতটি মিসকল আছে। কল করবো?
রেহনুমা: ওওও, এখন তো তিনটা বাজে; মনে হয় আম্মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি কাল সকালে ফোন দিলেই ভালো।
আমি: জি, তাই করি।
রেহনুমা: আর একটি চাওয়া ছিল।
আমি: কী লাগবে বলো।
রেহনুমা: আপনি আমাকে ‘তুমি’ করে বলবেন। আপনি মাঝে মাঝে ‘আপনি’ ও ‘তুমি’ গুলিয়ে ফেলেন।

আমি: ঠিক আছে — তাহলে আপনাকেও তুমি করে বলবো।
রেহনুমা: আমি পারবো না।
আমি: ঠিক আছে, তাহলে আমিও পারবো না।
রেহনুমা: ঠিক আছে, আমি রাজি; তবে আপনি আমাকে ‘আপনি’ করে বলবেন না — আমার ভালো লাগে না।
রেহনুমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফজরের আজান উঠে এলো। আমরা দুজনেই নামাজ আদায় করলাম।
আমি: রেহনুমা, শুনো—
রেহনুমা: জি, বলো।
আমি: আজ আমাদের অনেক জায়গায় যেতে হবে; তাই সকালে এখনি বের হতে হবে।
রেহনুমা: জি, আমি রেডি হচ্ছি। তুমি মা-কে একটা কল করবে।
আমি: ও, ভালো কথা!
আমি: হ্যাঁ, আম্মু… কেমন আছো তুমি?
আম্মু: ভালো আছি, তুই কেমন আছিস?
আমি: ভালো আছি…
আম্মু: ফোন রিসিভ করলি না যে! বৌ পেয়ে মায়ের কথা ভুলে ফেললি?
আমি: আম্মু, আমি বিশ্রামে ছিলাম; সাইলেন্ট ছিল।
আম্মু: বৌ মা কোথায়?
আমি: তোমার বৌমা? (আমি বলতেই রেহনুমা ইশারায় হাত নাড়ল — কথা বলবে না।)
আমি হেসে বললাম — “সামনেই আছে, কথা বলো।”
রেহনুমা আড্ডায় এগিয়ে এসে ফোন ধরল— “আসসালামু আলাইকুম, আম্মু!” আমি লাউডস্পিকারে দিলাম।
আম্মু কাঁদো কণ্ঠে বললেন— “ভালো আছিস মা?”
রেহনুমার মনে হলো এত মধুর ডাক জীবনে শোনেনি। সে নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল; চোখ ভিজে উঠল। রেহনুমা আম্মুর শরীরের খবর নিল। কথোপকথনের মাঝেই আমি রেহনুমার কোমর ধরে ওকে আমার কোলে বসিয়ে দিলাম — “নাও, বসে কথা বলো!”
রেহনুমা ভ্রু কুঁচকে আমাকে শাসন করার ভঙ্গি করল; কিন্তু একটু পরে লাফ দিয়ে সরল হয়ে গেল। ওইদিকে আম্মু জিজ্ঞেস করলেন — “কবে ফিরবি তোরা?”
রেহনুমা: “এই যে মা, ওর সাথে কথা বলুন।”
রেহনুমা আমার হাতে মোবাইল ফিরিয়ে দিলো।
আমি: শুন, আম্মু — আজকে বাসায় ফিরছি; রাতে হতে পারে।
এই বলে ফোন রেখে দিলাম। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি নাছির রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছে; আমি নাছিরের পাশে গিয়ে বসলাম।
আমি: নাছির, যা পেয়েছি সেটাও শুধুই তোর জন্য। তুই যদি সাহায্য না করতি তাহলে আমি একা আজকে সফল হতে পারতাম না।
নাছির: দেখ, এবার কিন্তু বেশি বেশি বলে ফেলছিস।
আমি: চল, আমরা বেরচ্ছি।
নাছির: আচ্ছা, ঠিক আছে — আজকে তোকে আটকাবো না।
আমি: আর ঘর সাজানোর জন্য ধন্যবাদ।
নাছির: ওটা তোর ভাবি করেছে।
সবাইকে বিদায় দিয়ে আমরা বের holo। আমার গাড়ির কাছে এসে—
আমি: রেহনুমা, তুমি এই গাড়িতে বসো; আমি আসছি।
রেহনুমা: কার গাড়ি এটা? আমি এই গাড়িতে বসবো কেন?
আমি: বসো, পরে বলব।
আমি: তো নাছির বলল কখন যাবি আমাদের বাসায় ভাবিকে নিয়ে?
নাছির: ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি।
আমি: তো আসি তাহলে।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমি গাড়িতে গিয়ে বসলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি রেহনুমা নেই। সে পিছনের সিটে বসে আছে।
আমি: তুমি পিছনে কেন? সামনে আসো।
রেহনুমা সামনে এসে বসল; আমি ড্রাইভ করা শুরু করলাম।
আমি: রেহনুমা, বলো — তোমার দুই বোন কোন হোস্টেলে থাকে?
রেহনুমা: Guwahati Medical College, Hostel Number 1.
আমি: ও, আচ্ছা — ঠিক আছে, চলো।
রেহনুমা: একটি প্রশ্ন করবো; সত্যি সত্যি উত্তর দিবেন, প্লিজ।
আমি: আচ্ছা, বলো কি জানতে চাও।
রেহনুমা: এই গাড়িটা কার? আপনি এতো দামি মোবাইল চালান, হাতে দামি ঘড়ি, দামি কাপড় — এইগুলো কোথা থেকে পেয়েছেন?
আমি: কোথা থেকে পাবো — এইগুলো আমারই।
রেহনুমা: এই গাড়িটা কার?
আমি: না, এটা বলা হবে না।
রেহনুমা: না।
আমি: ঠিক আছে — এটা আমার গাড়ি।
রেহনুমা অল্প অল্প ভয় পাচ্ছে।
রেহনুমা: এই গাড়ির দাম কত?
আমি: ১১ লাখ। আরো কিছু খরচ আছে।
রেহনুমা: কি হলো, দাঁড়ালেন কেন?
আমি: সামনে কি দেখছো — রেস্টুরেন্ট; চলো।
রেহনুমা: এখানে যাব কেন? (ভয়ে কথা ভালোভাবে বলছেই না)